Official Website of Kolkata Municipal Corporation
   
۩   প্রথম পাতা
কলকাতার পৌর ইতিহাস
 

মুঘল সম্রাট আকবরের প্রধানমন্ত্রী আবুল ফজল সংকলিত আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে কলকাতার উল্লেখ পাওয়া যায়। সম্রাট জাহাঙ্গীর বরিষার সাবর্ণ রায় চৌধুরি পরিবারকে কলকাতা এবং লাগোয়া বরিষা থেকে হালিশহর পর্যন্ত জমির জমিদারির অধিকার অর্পণ করেন।

গঙ্গার তীর বরাবর বাগবাজার থেকে বড়বাজার, সেখান থেকে বর্তমান এসপ্ল্যানেড এবং তারপর থেকে বর্তমান হেস্টিংস পর্যন্ত তিনটি নগণ্য গ্রাম সুতানুটি, কলকাতা এবং গোবিন্দপুর আজকের কলকাতার ভিত্তিভূমি। তখন রয়েছে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, বর্তমান উত্তর কলকাতার হাটখোলাতে ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ আগস্ট জব চার্ণক সুতানুটিতে পা রাখলেন। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ নভেম্বর সম্রাট ঔরঙ্গজেবের পৌত্র আজিম-উস-শান সাবর্ণ রায় চৌধুরিদের পরামর্শ দিলেন ১৩০০ টাকায় জমিদারি স্বত্ব ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে হস্তান্তর করতে।

১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লা কলকাতার ইংরাজ বসত আক্রমণের পর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে রবার্ট ক্লাইভ তা পুনর্দখল করলেন। পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৮ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি দেওয়ানি লাভ করার পর বাংলা প্রদেশে ব্রিটিশ দখল কায়েম হল। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা পৃথক প্রেসিডেন্সি রূপে গণ্য হল। একজন সভাপতি (প্রেসিডেন্ট) -এর নেতৃত্বে চার সদস্যের এক কাউন্সিলের উপর প্রশাসনের দায়িত্ব অর্পিত হল। যদিও কর সংগ্রহ এবং বিতর্কের মীমাংসার জন্য সরাসরি দায়ী রইলেন একজন জমিদার (কালেক্টর অফ কলকাতা)। কলকাতার ক্রমবিকাশে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানি ৩৮ টি প্রতিবেশী গ্রামকে অন্তর্ভুক্ত করলেন।

এক রাজকীয় সনদের (রয়্যাল চার্টার) মাধ্যমে ১৭২৬ খ্রিস্টাব্দের ৪ সেপ্টেম্বর একজন মেয়র এবং নয়জন অল্ডারম্যানকে নিয়ে প্রথম কর্পোরেশন গঠিত হল। অবশ্য এরা মেয়রস কোর্ট হিসাবে মূলত বিচার সংক্রান্ত কাজ দেখাশোনা করতেন। প্রশাসন তখন চালাতেন জমিদার, তাঁকে সাহায্য করতেন এক ডেপুটি যিনি ‘ব্ল্যাক জমিদার’ নামে পরিচিত ছিলেন।

১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে অপর এক রাজকীয় সনদে পৌর কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা এবং দায়িত্ব নতুন ভাবে স্থিরীকৃত হল। আলোকায়ন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক নির্মাণ, নিকাশি, পানীয় জল সরবরাহ প্রভৃতি ব্যবস্থা শহরের অগ্রগতির অবশ্যম্ভাবী ফল হিসাবে উঠে এল। ১৭৫৭ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হল ময়দান ক্লিয়ারেন্স, বর্তমান স্থানে ফোর্ট উইলিয়ামের স্থাপনার কাজ, চৌরঙ্গিতে ইউরোপীয়ান কোয়ার্টারের প্রসার।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দের সনদে শহরের ব্যবস্থাপনা গেল জাস্টিস অফ পিসের হাতে। ১৭৯৪ থেকে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এদের অধ্যক্ষ (চেয়ারম্যান) একই সঙ্গে নগরপাল (পুলিশ কমিশনার) এবং মিউনিসিপ্যালিটির মুখ্য কার্যনির্বাহী আধিকারিক (চিফ এক্সিকিউটিভ) হিসাবে কাজ করতে লাগলেন। ১৮০৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলির হস্তক্ষেপে একটি ‘শহর উন্নয়ন কমিটি’ (টাউন ইমপ্রুভমেন্ট কমিটি) গড়ে উঠল ত্রিশ জন সদস্য নিয়ে।

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে নগর উন্নয়নের জন্য টাকা তোলা হত লটারি ব্যবস্থার মাধ্যমে। গঠিত হল লটারি কমিটি। এদের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি টাউন হল, বেলেঘাটা খাল এবং বহু রাস্তা।

১৮৪০ খ্রিস্টাব্দের আইনে কর মূল্যায়নে করদাতারা সামিল হলেন। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের আইনে তৈরি হল সাত সদস্যের বোর্ড, যার মধ্যে চার জন হলেন নির্বাচিত। ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে সদস্য সংখ্যা কমে হল চার জন – যার দু’জন সরকারের দ্বারা নিয়োজিত এবং বাকি দু’জন নির্বাচিত। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে সংখ্যাটা কমে হল তিন জন, যারা নিয়োজিত হলেন লেফট্যানেন্ট গভর্নর দ্বারা।

১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে মিউনিসিপ্যাল সরকারের দায়িত্ব নেন কলকাতার ‘জাস্টিস অফ পিস’ এবং প্রদেশের বিচারকরা, যারা এই শহরের বাসিন্দা। এদের রইল নিজেদের ভাইস চেয়ারম্যান, রেগুলার স্বাস্থ্য আধিকারিক, বাস্তুকার, অবেক্ষক, কর নির্ধারক ও কর সমাহরক। এল জলকর, গৃহকর বর্ধিত হল সর্বাধিক দশ শতাংশ পর্যন্ত। জল সরবরাহ, নিকাশি ব্যবস্থা ছাড়াও এদের আমলে এল নিউ মার্কেট (১৮৭৪), পৌর কসাইখানা (১৮৬৬)।

১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল কনসোলিডেশন অ্যাক্ট’। তৈরি হল এক কর্পোরেশন; রইল ৭২ জন কমিশনার, ১ জন চেয়ারম্যান এবং ভাইস চেয়ারম্যান। ৪৮ জন কমিশনার নির্বাচিত হলেন করদাতাদের দ্বারা এবং ২৪ জন নিয়োজিত হলেন সরকারের মাধ্যমে। ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে পৌর পরিধি বেড়ে গেল। সংযুক্ত হল শহরতলির কিছু অংশ - লোয়ার সার্কুলার রোডের পূর্ব ও দক্ষিণ অংশ। এর ফলে ৭ টি নতুন ওয়ার্ড কলকাতার সঙ্গে যুক্ত হল। শহরের উত্তর অংশের ৩ টি ওয়ার্ডও এই সঙ্গে যুক্ত হল। কমিশনারের সংখ্যা বেড়ে হল ৭৫ জন। ৫০ জন নির্বাচিত এবং সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কমিশনার হলেন ১৫ জন। বাকি ১০ জন কমিশনার নিয়োগ করত চেম্বার্স অব কমার্স, ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং পোর্ট কমিশনার্স।

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ম্যাকেঞ্জী অ্যাক্টে এল বিরাট পরিবর্তন। কলকাতার প্রশাসন অর্পিত হল তিনটি সমন্বয়কারী কর্তৃপক্ষের উপরে – কর্পোরেশন, জেনারেল কমিটি এবং চেয়ারম্যান।

সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি বাৎসরিক মেয়র নির্বাচনের মাধ্যমে পৌর সরকারের গণতন্ত্রের বুনিয়াদ দৃঢ় করলেন। বাংলায় ‘লোকাল সেলফ্ গভর্নমেন্ট’-এর প্রথম মন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি হলেন ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইনের স্থপতি। এই সময়েই কাশীপুর, মানিকতলা, চিৎপুর এবং গার্ডেনরিচ কলকাতার সঙ্গে যুক্ত হল। পরবর্তী কালে গার্ডেনরিচকে কলকাতা থেকে আলাদা করা হয়। প্রথম নির্বাচিত মেয়র হলেন চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সুভাষচন্দ্র বসু হলেন চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। রাজ্য সরকার কর্পোরেশনকে অধিগ্রহণ করার আগে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস অবধি এই আইনে চলত শহর।

১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১ মে ‘কলকাতা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৯৫১’ চালু হল। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এল ‘অ্যাডাল্ট ফ্রানচাইস’। চলল পরিবর্তন, ভাঙা গড়ার পর্ব। ওয়ার্ডের সংখ্যা বেড়ে ৭৫ থেকে ১০০ হল। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ১ এপ্রিল টালিগঞ্জ কলকাতার সঙ্গে যুক্ত হল। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের পৌর আইনে একজন নির্বাচিত মেয়র, একজন ডেপুটি মেয়র এবং পাঁচ জন অল্ডারম্যানের পদ নির্দিষ্ট হল। তিনটি সমন্বয়কারী কর্তৃপক্ষ হল – কর্পোরেশন, স্ট্যান্ডিং কমিটি এবং কমিশনার।

১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে রাজ্য সরকার কর্পোরেশনকে অধিগ্রহণ করলেন। এর আগে পর্যন্ত কাজ চলল ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের আইনে। ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস থেকে কার্যকর হল ‘ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্ট, ১৯৮০’। এইভাবে বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে আজ আইন মোতাবেক তিনটি কর্তৃপক্ষীয় স্তর – কর্পোরেশন, মেয়র পরিষদ এবং মেয়র।

বর্তমানে যাদবপুর, সাউথ সাবার্বান এবং গার্ডেনরিচ পৌরসংস্থায় আত্তীকরণের পর নির্বাচিত পৌর প্রতিনিধি (কাউন্সিলার)-এর সংখ্যা ১৪১, ওয়ার্ড ১৪১ টি এবং মোট বরো ১৫ টি। করদাতাদের ও শহরের উন্নতিকল্পে সময়ে সময়ে হচ্ছে আইন সংশোধন। কলকাতা ধীরে ধীরে পা ফেলছে তিলোত্তমা হবার পথে।

 
উপরে