বর্তমান সম্পত্তি কর নির্ধারন পদ্ধতি :
বর্তমানে ‘অ্যানুয়াল রেটেবল্ ভ্যালু’ বা ARV পদ্ধতিতে সম্পত্তিকর নির্ধারিত হয়। এই পদ্ধতিতে কোন সম্পত্তি থেকে যে বার্ষিক ভাড়া পাওয়া যায় বা ভাড়া দিলে ন্যায়সঙ্গত ভাবে যে বার্ষিক ভাড়া পাওয়া যেতে পারে তার থেকে ১০ শতাংশ মেরামতি খাতে ছাড় দিয়ে সম্পত্তির বার্ষিক মূল্য (AV বা ‘অ্যানুয়াল ভ্যালু’) নির্ণয় করা হয়।
বর্তমান পদ্ধতিতে বার্ষিক মূল্য বৃদ্ধির সাথে সাথে করের হার একটি আপাতঃ জটিল পদ্ধতি মেনে সর্বনিম্ন ১১ শতাংশ এবং ঊর্ধ্বতম ৪০ শতাংশ সীমার মধ্যে বাড়তে থাকে। প্রসঙ্গত, উক্ত করের হার যদিও সম্পত্তির স্বতন্ত্র বার্ষিক মূল্যের উপর নির্ভরশীল কিন্তু আইনবলে, সাধারণ ফ্ল্যাট বাড়ির ক্ষেত্রে সমস্ত ফ্ল্যাটগুলির বার্ষিক মূল্যের যোগফলের উপর নির্ভর করে স্বতন্ত্র ফ্ল্যাট এর বার্ষিক করের হার নির্ধারিত হয়। এছাড়াও, কোন সম্পত্তি ব্যবসায়িক কাজে ব্যবহৃত হলে এই করের উপর বাড়তি ৫০ শতাংশ সারচার্জ নেওয়া হয়।
বর্তমান পদ্ধতির সমস্যা :
অঞ্চলভেদে এবং সম্পত্তিভেদে ন্যায়সঙ্গত ভাড়া নির্ণয়ের কোনও সুনির্দিষ্ট এবং বিজ্ঞাপিত বিধি না থাকার ফলে এইভাবে কর নির্ণয় পদ্ধতিতে ব্যক্তি নির্ভরতা এবং অসামঞ্জস্য সৃষ্টির সম্ভাবনা থেকে যায় যা করদাতার কাছে কারণে বা অকারণে অনেক সময়ই অন্যায্য বলে মনে হতে পারে।
ভাড়া দেওয়া সম্পত্তিতে অনেক সময় ভাড়ার তথ্য সঠিক ভাবে উপস্থাপিত হয় না।
উপরোক্ত পদ্ধতিতে প্রচুর আইনি জটিলতার সৃষ্টি হয়। এর ফলে অনেকক্ষেত্রেই করদাতারা আইন আদালতের আশ্রয় নেওয়ায় মূল্যবান অর্থ এবং সময় দুই-এরই অপচয়ের সম্মুখীন হন।
পরিষ্কার ভাবে অঞ্চলভিত্তিক বা সম্পত্তিভিত্তিক বার্ষিক ভাড়া ইত্যাদি বিজ্ঞাপিত না থাকার কারণে করদাতার পক্ষে সম্পত্তির স্ব-মূল্যায়ন করা হয় না এবং গোটা বিষয়টাই পৌরসংস্থাতে করনির্ধারণের কাজে যুক্ত ব্যক্তি বিশেষের আপেক্ষিক ধারণার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। যার সূত্র ধরে অনেক সময় ঘটে অনিয়ম এবং জটিলতার অনুপ্রবেশ।
‘ইউনিট এরিয়া অ্যাসেসমেন্ট’ পদ্ধতি :
উপরোক্ত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে ভারতবর্ষের অনেক শহরে অঞ্চল ভিত্তিক সম্পত্তি কর নির্ধারণ পদ্ধতি বিভিন্ন নাম দিয়ে চালু হয়েছে বা চালু করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কলকাতা শহরের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির নাম দেওয়া হয়েছে ইউনিট এরিয়া অ্যাসেসমেন্ট বা UAA পদ্ধতি।
এই পদ্ধতিতে সম্পত্তিকর নির্ধারণের ক্ষেত্রে নীচের ফর্মূলাটি (সংক্ষিপ্ত) প্রয়োগ করা হবে। :

এই পদ্ধতি অনুসারে কলকাতা শহরের ১৪১টি ওয়ার্ডকে প্রাথমিক ভাবে ২৯৩টি ব্লকে ভেঙ্গে সেই ব্লকগুলিকে জমির মূল্য, পরিকাঠামোগত সুযোগ সুবিধা ও অন্যান্য বিষয়গুলির উপর নির্ভর করে A থেকে G ৭টি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রত্যেক শ্রেণিভুক্ত ব্লকের (যথাক্রমে A, B, C, D, E, F, G) সম্পত্তির জন্য বর্গফুট পিছু বার্ষিক মূল্য তথা BUAV নির্দিষ্ট করে দেওয়া থাকবে। A শ্রেণিভুক্ত ব্লকের সবথেকে বেশি এবং G শ্রেণিভুক্ত ব্লকের সবথেকে কম BUAV হবে, এর মাধ্যমে একই ব্লক বা একই শ্রেণিভুক্ত ব্লকের সম্পত্তিগুলির প্রাথমিক বার্ষিক মূল্যের ক্ষেত্রে অঞ্চলভিত্তিক একটি বৃহত্তর সাম্য (Macro Level Equity) আনা সম্ভব হবে।
মূল্যায়ণের সুবিধার জন্য, যেকোনো অঞ্চল/ব্লক/শ্রেণি অন্তর্ভূক্ত বস্তি এলাকাগুলিকে G শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। একইভাবে, সরকারী নোটিশপ্রাপ্ত EWS এবং BSUP স্কিম এর অন্তর্গত RR কলোনিগুলিকে (E শ্রেণির নিম্ন শ্রেণিভুক্ত RR কলোনিগুলি ছাড়া) E শ্রেণির অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও কলকাতার মতন শহরে যেখানে একই অঞ্চলে হতদরিদ্র বস্তি এবং উচ্চকোটির শপিংমল সহাবস্থান করে সেখানে একই ব্লকে অবস্থিত সম্পত্তিগুলির মধ্যে সূক্ষতর পর্যায়ে সম্পত্তির বয়স, নির্মানের ধরন, বাড়িতে ভাড়া থাকা বা না থাকা এবং ব্যবহারের প্রকৃতির মাপকাঠিতে ন্যায়সঙ্গতির জন্য কিছু মাল্টিপ্লিকেটিভ ফ্যাক্টর এবং তার মান নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে যার সাহায্যে সম্পত্তিভেদে বর্গফুট পিছু বার্ষিক মূল্য কমানো বা বাড়ানো বা একই রাখা সম্ভব হবে।
UAA পদ্ধতিতে বার্ষিক কর নির্ধারণের ক্ষেত্রে শতকরা হার (Rate %) স্থির (Fixed) করে বিজ্ঞাপিত করে দেওয়া হবে এবং তার মান ৬ থেকে ২০ শতাংশের মধ্যে থাকবে। ইতিমধ্যে উন্নত বস্তির ক্ষেত্রে এই হার ৮ শতাংশ স্থির করা হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই এই পদ্ধতিতে সাধারণ ফ্ল্যাটের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র বার্ষিক করের হার বাড়ির সকল ফ্ল্যাটের বার্ষিক মূল্যের উপর নির্ভর করবে না ফলে স্বতন্ত্র ফ্ল্যাটের কর তার স্বতন্ত্র বার্ষিক মূল্যের উপরই নির্ভর করবে।
প্রসঙ্গত, উক্ত ব্লক বিভাজন এবং শ্রেণি বিন্যাস স্থির করার আগে করদাতাদের মতামত গ্রহণের জন্য একটি ড্রাফ্ট্ নোটিফিকেশন অফিসিয়াল গেজেটে বিজ্ঞাপিত করা হয়েছিল। বেস ইউনিট এরিয়া ভ্যালু (BUAV) নির্ধারণের সময়ও এই সুযোগ দেওয়া হবে।
উপরোক্ত শ্রেণিবিন্যাস এবং বিভিন্ন বিষয়ে মান নির্ধারণের জন্য সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে একটি মিউনিসিপাল ভ্যালুয়েশন কমিটি গঠন করা হয়েছে, আর একই ভাবে শ্রেণিবিন্যাসের ক্ষেত্রে কোন অসঙ্গতি থাকলে নাগরিকদের অভিমত খতিয়ে দেখার জন্য গঠিত হয়েছে একটি অ্যানোমালি রিভিউ কমিটি। এই ভাবে স্থির হওয়া শ্রেণিবিন্যাস বা বিভিন্ন মূল্যমান গুলি প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পুনরায় পর্যালোচনা করা হবে।
যেহেতু এই পদ্ধতিতে কর নির্ধারণের জন্য সকল প্রয়োজনীয় উপাদানই যথা শ্রেণিবিন্যাস, বেস ইউনিট এরিয়া ভ্যালু, মাল্টিপ্লিকেটিভ ফ্যাক্টর এর মান এবং করের হার পরিষ্কার ভাবে বিজ্ঞাপিত করে দেওয়া হবে সেহেতু প্রত্যেক করদাতাই পৌরসংস্থার কর্মচারীর উপর নির্ভর না করে সম্পত্তির স্ব-মূল্যায়ন (Self-Assessment) করে কর জমা দিতে পারবেন।
এই ভাবে UAA পদ্ধতির মাধ্যমে একটি বস্তুনিষ্ঠ, স্বচ্ছ, ন্যায়সঙ্গত ও সহজবোধ্য কর নির্ণয় পদ্ধতি রূপায়ণের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে স্ব-মূল্যায়ণের সুযোগ দিয়ে নাগরিকদের হাতে অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করা।
|